মাসিক মিস করার আগেই কিভাবে বুঝবেন আপনি গর্ভবতী? বা গর্ভাবস্থার লক্ষণ ও পিরিয়ডের লক্ষণ কিভাবে বুঝবো? এই প্রশ্নটা অনেক বিবাহিত মহিলাদের থাকে। বিশেষ করে যাদের মাসিক অনিয়মিত হয় তারা এইটা জানতে চান। আজকের এই পোষ্টটা পড়লে আপনি 12টি শারীরিক পরিবর্তন সম্পর্কে জানতে পারবেন। এবং এই পরিবর্তনগুলোর মাধ্যমে আপনি বুঝতে পারবেন আপনি আসলে গর্ভবতী কি না। এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন ডা. তাসনিম জারা (ইংল্যান্ড)।
গর্ভাবস্থার লক্ষণ ও পিরিয়ডের লক্ষণ জেনে নিন
যোনিপথ দিয়ে হালকা রক্তপাত: গর্ভধারণের ছয় থেকে বারো দিনের মধ্যে যোনিপথ দিয়ে হালকা রক্তপাত বা ইমপ্লান্টেশন ব্লিডিং হয়ে থাকে। এখন জানার বিষয় এটা কেন হয় বা এটা কিভাবে হয়? নারীদের কমড়ের নিচে তলপেটের দিকে ডিম্বাশয় নামের একটা জায়গায় ডিম্বাণু পরিপক্ক হয়। তারপর সেখান থেকে ডিম্বাণু বের হয়ে ডিম্বো নালিতে ডুকে। আর এই ডিম্বো নালীতে পুরুষের শুক্রাণু এসে মিলিত হয়। মিলিত হওয়ার পরই একটা ডিম্বাণু কেবল একটা শুক্রাণু দিয়ে নিষিক্ত হয় এবং ভ্রুণ সৃষ্টি হয় এবং এখান থেকেই শিশু তৈরি হয়। এখন ভ্রুণের কাজ হচ্ছে বড় হওয়ার জন্য সুন্দর বড় জায়গার। তাই সে আর অন্যদিকে চিন্তাভাবনা না করে সরাসরি জরায়ুতে চলে আসে। আর এই জরায়ুতেই সে আগামী 9-10মাস অবস্থান করে এবং আসতে আসতে সেখানেই বড় হতে থাকে। জরায়ুতে পৌঁছানোর পরে এই ডিম্বাণুর প্রথম কাজ হচ্ছে নিজের জন্য একটু ভালো করে জায়গা করে নেওয়া। এটা সে কিভাবে করে? জরায়ুর সঙ্গে ভালো ভাবে জড়িয়ে নেয়। এই জড়িয়ে নেওয়ার কাজটা যখন সে করে ঠিক তখনই যোনিপথ দিয়ে হালকা রক্তপাত ঘটে। আর এটাই হচ্ছে গর্ভধারণের জন্য প্রাথমিক একটা লক্ষণ। অনেকই এই রক্তকে মাসিকের রক্ত ভেবে ভুল করেন। এখন আমি বুঝিয়ে দিবো কোনটা মাসিকের রক্ত আর কোনটা গর্ভধারণের রক্ত।
- প্রথম পার্থক্য হলো- মাসিকের রক্তপাত উজ্জ্বল বা গাঢ় লাল অন্যদিকে গর্ভধোরণের রক্ত হলো হালকা গোলপি বা বাদামি।
- দ্বিতীয় পার্থক্য হলো- মাসিকের রক্তের পরিমাণ ভারী অর্থাৎ বেশি হবে আর গর্ভধারণের রক্তের পরিমাণ খুবই অল্প।
- তৃতীয় পার্থক্য হলো- মাসিকের হয় রক্তগুলো চাকা চাকা ধরণের হয় আবার ইমপ্লান্টেশন ব্লিডিং বা গর্ভধারণের জন্য রক্ত সাধারণত চাকা চাকা হয় না।
আশা করি আপনার মাসিকের রক্ত এবং ইমপ্লান্টেশন ব্লিডিং এর মধ্যে পার্থক্য বুঝেছেন। গুরত্বপূর্ণ একটা কথা হচ্ছে ইমপ্লান্টেশন ব্লিডিং না হলে হতাশার কিছু নাই। প্রতি 100জন নারীর মধ্যে মাত্র 25জনের ক্ষেত্রে এমন রক্তপাত হয়। বাকি 75জনের কিন্তু এই গর্ভধারণের রক্তপাত হয় না। সুতরাং অন্যান্য লক্ষণগুলো আমাদের জানতে হবে এবং সেই লক্ষণগুলোর দিকেও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।
স্তন ভারী ভারী মনে হওয়া ও হালকা ব্যথা: এই লক্ষণটাও মাসিক হওয়ার আগেই খেয়াল করতে পারেন। গর্ভধারণের প্রথম এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যেই স্তন হালকা ব্যথা হতে পারে। এই ব্যথা ছাড়াও স্তনে আরও কয়েকটি লক্ষণ অনুভব করতে পারেন। যেমন- স্তন আগের থেকে বড় বা ফোলা মনে হতে পারে। স্তনের বোটা বা এর চারদিকে শিরশির লাগতে পারে এবং স্তন ভারী ভারী মনে হতে পারে। সব মিলিয়ে বলতে গেলে স্তনে কিছুটা অন্যরকম লক্ষণ প্রকাশ পায়। প্রশ্ন হচ্ছে কেন এমন হয়? গর্ভধারণ করলে শরীরের বিশেষ কিছু হরমোনের পরিবর্তন হয়। আর এর ফলেই স্তনের বিশেষ কিছু পরিবর্তন আসে। সুতরাং স্তনের ব্যথা ও ভারী ভারী ভাব হওয়াও গর্ভধারণের একটা কারণ হতে পারে। তারপরও আমাদের অন্য লক্ষণগুলোর দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।
ঘন ঘন প্রসাব: গর্ভধারণ করার পরপরই এই লক্ষণটা প্রকাশ পেয়ে থাকে। যেমন- ঘন ঘন টয়লেটে যাওয়া কিংবা ঘন ঘন প্রসাব হওয়া। কেন এমন হয়? গর্ভাবস্থায় বিশেষ হরমোনের প্রভাবে নারীদের তলপেটে রক্ত চলাচল বেড়ে যায়, কিডনিতে রক্ত চলাচল বেড়ে যায় ফলে ঘন ঘন প্রসাবের চাপ আসে। কিন্ত ঘন ঘন প্রসাবের চাপের সাথে ব্যথা হয়, প্রসাবের রাস্তায় জ্বালাপোড়া করে তাহলে অবশ্যই ডাক্তার দেখাতে হবে। কারণ প্রসাবের রাস্তায় কোন না কোন ইনফেকশন হয়।
পেটে অস্বস্তি বা পেট ফাঁপা: গর্ভাবস্থার শুরুর দিকে যে হরমোনের পরিবর্তন আসে সেগুলোর কারণে পেট ফোলা ফোলা বা ফাঁপা মনে হতে পারে। অনেকেই বলে থাকেন পেটে মনে হয় একটু গ্যাস জমা হয়ে আছে। কাপড় পরিধান করার সময় কমড়ের দিকে একটু চাপা মনে হতে পারে।
মুড সুইং: গর্ভাবস্থায় প্রথম দিকে আপনার মন মেজাজ অন্যরকম হয়ে যেতে পারে। যেমন- এই ভালো লাগে আবার এই খারাপ লাগে, কান্না কান্না লাগে। যেন মুহূর্তের মধ্যেই মনে রং বদলে যাচ্ছে। এটা শুধু আপনার জন্যই না, এটা সবার ক্ষেত্রেই ঘটে। আসলে বিশেষ এক হরমোনের কারণে এমনটা হয়ে থাকে।
বমি বমি ভাব ও বমি: আগে ধারণা করা হতো বমির ভাব আর বমির লক্ষণটা কিছুটা দেরিতে আস। কিন্তু 2021 সালে প্রকাশিত ইউনির্ভাসিটি অব ওয়ার্ল্ডের করা গবেষণায় দেখা যায়, গর্ভধারণের একদম শুরুর দিকে এই লক্ষণটা দেখা দিতে পারে। ডিম্বাণু ফোটে বের হওয়ার আট দিনের মাথাতেই কারও কারও এই লক্ষণটা দেখা দেয়। যাদের ওজন বেশি তাদের ক্ষেত্রে লক্ষণটা আগে দেখা দেয়। আবার যাদের বয়স বেশি তাদের ক্ষেত্রে একটু দেরিতে প্রকাশ পায়। যেমন- 21 বছর বয়সে কারও 14তম দিনের মাথায় এই লক্ষণটা দেখা দিতে পারে। কিন্তু যার বয়স 33 বছর, তার ক্ষেত্রে আর একটু দেরিতে আসতে পারে। যেমন- 18তম দিনের মধ্যে এমন বমি বমি ভাব দেখা দিতে পারে।
স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ক্লান্তি: এটা মাসির দেরি হওয়ার আগেই গর্ভধারণের একদম এক সপ্তাহের মধ্যেই লক্ষণ দেখা যায়। যে কাজগুলো করতে আপনার আগে গায়েই লাগতো সেই কাজ গুলো একটু করলেই আপনার প্রচুর ক্লান্ত লাগে। কেন এটা হয় এর কারণ এখনো বিজ্ঞান খুঁজে পায়নি। তবে প্রোটিসটু নামক এক হরমোনের কারণে এমনটা হয় ধারণা করা হয়। তবে প্রথম তিন মাস পার হয়ে গেলে কিছুটা ক্লান্তি নেমে আসে। এর মাঝে আর তেমন ক্লান্তি লাগে না। কিন্তু শেষের তিন মাস আবার সেই আগের মতোই ক্লান্তি নেমে আসে।
মুখের স্বাদ পাল্টে যাওয়া: গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে মুখের স্বদটা পাল্টে যায়। অনেক গবেষণায় দেখা গেছে গর্ভাবস্থায় দুই ধরনের পরিবর্তন হবেই। এক, খাবারে আগের থেকে একটু লবণ দিলে স্বাদ লাগে কিংবা নোনতা খাবার বেশি ভালো লাগে। দুই, অন্যদিকে তেতো খাবার আগের থেকে কম ভালো লাগে। এই সময় কেউ কেউ মুখে এক অদ্ভদ স্বাদ পায়, অনেকটা ধাতব পদার্থের মতো।
প্রখর ঘ্রাণশক্তি: গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে ঘ্রাণশক্তি আগের থেকে বেশি হয়। বলতে পারেন এক ধরনের সুপার পাওয়ারের মতো। কিন্তু অনেকের কাছে এটা খুবই বিরক্তির একটা কারণ। গবেষণায় দেখা গেছে, অনেকের ক্ষেত্রে পচাঁ খাবারের গন্ধ খুব প্রকট ভাবে নাকে লাগে। আবার অনেকেই তো এই গন্ধগুলোর কারণে রান্ন ঘরে যেতেই চায় না যার ফলে অন্য কাউকে সেই দায়িত্বটা দিতে হয়। এক কথায় আমাদের স্বাভাবিক ঘ্রাণের চেয়ে অন্যরকম ঘ্রাণ আসে।
খাবারে অনীহা: যে খাবার আপনার খুব ভালো লাগতো বা আপনি নিয়মিত খেতেন সেই খাবার এখন একদমই ভালো লাগে না। কারও কারও মাংস খাওয়ার অরুচি আসে বা কেউ কেউ মাছ বা অন্য সকল খাবারগুলো খেতে পারেন না। অথচ সেই খাবার গুলো আপনার খুবই পছন্দনীয় খাবার। আবার অনেকের কাছে এর উল্টোও হতে পারে। তা হচ্ছে পরের লক্ষণ।
খাবার খাওয়ার তীব্র ইচ্ছা: গর্ভাবস্থার শুরু দিকে নির্দিষ্ট কিছু খাবার খাওয়ার তীব্র ইচ্ছা জাগতে পারে। যেমন- হঠাৎ করেই মনে হতে পারে মিষ্টি কিছু খেতে বা টক কিছু খেতেই হবে। এই ক্ষুধাটা অন্য ক্ষুধার মতো না। বলতে পারেন অনেকটা মনের ক্ষুধা।
মাথা ব্যথা: গর্ভাবস্থার শুরুর দিকে অনেকেরই মাথা ব্যথা করে। এটা ঘটে সাধারণত হঠাৎ করে শরীরের হরমোনের মাত্রা বেড়ে গেলে। এই মাথা ব্যথাটা আসলে অনেকটা বেশি এমন নয়। এই মাথা ব্যথাটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
উপরোক্ত এই লক্ষণগুলোই দেখা দিলেই যে আপনি গর্ভবতী বা গর্ভবতী নয় এমনটাও নয়। এখানে যে লক্ষণগুলো পড়লেন এই কারণগুলো গর্ভবতী ছাড়াও হতে পারে। নিশ্চিত হওয়ার জন্য অবশ্যই আপনাকে প্রেগন্যান্সি টেষ্ট করে নিতে হবে। এখন কথা হচ্ছে কখন এই টেষ্ট করাবেন? যাদের মাসিক নিয়মিত তাদের মাসিকের তারিখ মিস হওয়ার পরের দিনই এই টেষ্ট করাবেন। যাদের মাসিক অনিয়মিত তাদের ক্ষেত্রে সর্বশেষ মাসিক থেকে 36 দিন পরেই তারা টেষ্ট করবেন। আর আপনার যদি ব্লিডিং হয় এবং আপনি নিশ্চিত হতে পারছেন না যে এটা আসলে কিসের রক্তপাত। তাহলেও আপনি প্রেগন্যান্সি টেষ্ট করে নিবেন। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে কখনই প্রেগন্যান্সি টেষ্ট করতে অবহেলা করবেন না। কারণ আপনি যদি গর্ভবতী হন সাথে সাথেই কিছু ভিটামিন মিনারেল ওষুধ খাওয়া খুবই জুরুরি। বিশেষ করে আয়রন এবং ফলিক এসিড। এইগুলো খেলে বাচ্চার জন্মগত ত্রুটি থাকলে মোটামুটি তা অনেকটায় নিরাময় হতে পারে।
‘‘গর্ভাবস্থার লক্ষণ ও পিরিয়ডের লক্ষণ’’ আজকের এই বিষয়ে আলোচনা করেছেন ডা. তাসনিম জারা (ইংল্যান্ড)।