ট্রেনে চড়ে ইতালি থেকে সুইজারল্যান্ড ভ্রমণ
কি যে ভাল লাগছে আমি বলে বোঝাতে পারবো না। পুরা বরফে আচ্ছাদিত জায়গাগুলো পার করছি। চলুন, আজ আমার সাথে সুইজারল্যান্ডে। পৃথিবীর ভূস্বর্গখ্যাত এই রাষ্ট্রে আজ আমরা ইতালি থেকে ট্রেনে চড়ে চমৎকার একটি যাত্রা উপভোগ করবো। এই ভ্রমণে আমরা দেখবো পাহাড়, পর্বত, ঝিরি, লেক, অরণ্য। আর তার সাথে একই যাত্রায় 2 - 3 পদের ঋতুচক্র। শুধুৃ আমার কথা নয়, বিভিন্ন সমীক্ষায় এই যাত্রাটি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর কিছু ট্রেন যাত্রার একটি বলে বিবেচিত। পুরো পর্বটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত থাকবেন। খুব ভালো একটা অনুভূতি পাবেন বলে আশা করছি।
পাহাড়-পর্বত, সুমিষ্ঠ জলের লেক এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক আশ্চর্যের জন্য বিখ্যাত দেশ ইতালি থেকে আপনাদের সকলকে জানাচ্ছি স্বাগতম। আমাদের আজকের যাত্রাটি ইতালি থেকে সুইজারল্যান্ড বরাবর। এবং সুইজারল্যান্ড যাচ্ছি বিধায় আমি আছি ইতালির কোলিকো নামের একটি ট্রেন স্টেশনে। যে স্টেশনটা মোটামুটি ইতালির উত্তর বরাবর অবস্থিত। এবং এই স্টেশনের ঠিক পিছনেই রয়েছে একটা পাহাড়। আর এই পাহাড়ের উপরেই খন্ড খন্ড বরফ জমে আছে। মেঘগুলো এসে মিশেছে এবং আশেপাশে একটা ঠান্ডা ঠান্ডা খুব মেঘঘ মাখা পরিবেশ। খুবই অসাধারণ একটা পরিবেশ এই স্টেশনে। আমরা মিরান থেকে প্রায় এক থেকে দের ঘন্টা যাত্রা করে এখানে এসে পৌঁছেছি। এখান থেকে একটা ট্রেন পাল্টে আমরা যাচ্ছি তিরানো নামের একটা অঞ্চলে। এবং তিরানো থেকে আমরা পরবর্তীতে যে মূল ট্রেনটা, বারনীরা এক্সপ্রেস করে আমরা যাবো সুইজারল্যান্ড বরাবর। চলুন আমাদের পরের যাত্রাটা শুরু করি।
আমরা যে ট্রেনটাতে চড়েছি সেখানে সেকেন্ড ক্লাসের টিকেট কেটেছি। এই শ্রেণীতেও সীটের মান বেশ ভালোই লাগছে। ইতালি উত্তরাঞ্চলের প্রকৃতি দৃশ্য খুবই মনোমুগ্ধকর। মিলান থেকে লেক কোমর পাশ দিয়ে মনোরম দৃশ্য দেখতে দেখতে কিছু পথ এসছি। এখান থেকে মেঘ মাখা আকাশের নিচে, ইতালির শ্যামল সবুজ পাহাড় পর্বতে মেঘের ছায়াগুলোও দেখছি। আমার সাথে তিরানো পর্যন্ত পথের চমৎকার দৃশ্যগুলো।
আমার ভ্রমণে অনুপ্রাণিত হয়ে যদি আপনারাও ঘুরতে চান, তাহলে প্রতিষ্ঠানটি আপনাদের জন্য। বাংলাদেশের পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে পছন্দের যে আন্তর্জাতিক গন্তব্যগুলো। সেগুলোর অনেকগুলো ট্যুর বুক করতে পারবেন GoZayaan এর মাধ্যমে। ঘরে বসে পছন্দের ট্যুরগুলো কাস্টমাইজ করে বুক করতে পারবেন তাদের ওয়েবসাইট অথবা অ্যাপে।
চলে আসলাম তিরানোতে। পাহাড় ঘেরা শহর। খুব সুন্দর একটা শহর। তিরানোতে নেমে আমরা প্রথমে দুপুরের খাবার খাওয়ার রেস্তোরাঁ খুঁজছি। ইতালিতে ট্রেন ডিলে হবার সুযোগ থাকে। তাই আমরা সুইজারল্যান্ডের ট্রেন ধরার আগে আড়াই ঘন্টার বিরতি হাতে রেখেই আগের টিকেট কেটেছি। ইতিমেধ্যেই আগের যাত্রার এক ঘন্টার ডিলে পার করলাম। এখানে খেলাম পাস্তা, পিজ্জা।
ইতালির ভিতরে সুইজারল্যান্ডের সীমানায় প্রবেশ করছি। ব্যাপারটা অনেকটা বিমানবন্দরের মত। যদিও ভূমিটা ইতালির, তবে স্টেশন আর ট্রেনটি সুইজারল্যান্ড বলে বিবেচিত। আমাদের ট্রেনটি 2 টায় ছাড়বে। চিত্রে দেখানো ট্রেনটিতেই আমরা সুইজারল্যান্ড যাবো। এবং এটাতে কতো খরচ পরেছে, কি পরেছে আমি সবকিছু সর্ম্পকে বিস্তারিত বলবো।
আামাদের ট্রেনটি ঠিক দুপুর 2.24টায় ছেড়ে দিলো। এবং বের হওয়ার সাথে সাথে দৃশ্য সব শুরু হয়ে গেছে। অসাধারণ সব পাহাড় পর্বত এর দৃশ্য। আমি যে ট্রেনে যাত্রা করছি সেই ট্রেনটার নাম হচ্ছে বিরনিনা এক্সপ্রেস। আমার এই ট্রেনে মোট চার ঘন্টার যাত্রা হবে।
ইতালি সুইজারল্যান্ডের এই পথে সবচেয়ে আর্কষণীয় কিছু মানবসৃষ্ট বিষয়ের একটি এই Brusio Spiral Viaduct. 1908 সালে প্রতিষ্ঠিত এই ভিউডাক, প্রায় 400 ফুটের খাড়া উচ্চতাকে পেঁচের মাধ্যমে সহজেই কমিয়ে আনতে সাহায্য করে। একটু যখন উপরে উঠছি, সবুজের ফাঁকে দূর প্রান্তের বরফে ঢাকা পর্বতগুলোর দেখা পেয়েছি। কি যে সুন্দর লাগছে। 4.5 সুইস ফ্রাঙ্কে আমার প্রথম কফি অর্ডার করলাম। তাতে চুমুক দিয়ে, প্রকৃতির এই রূপ মন ভরে দেখছি।
ইতিমধ্যে আমি দেখছি পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে মেঘ জমেছে। সুইজারল্যান্ডের বরফে আচ্ছাদিত পর্বতমালা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। সুন্দর সুন্দর পথ-ঘাট নিচে দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ ট্রেন থেকে আওয়াজ আসলো আমরা ইতিমধ্যে 1000 মিটার বা প্রায় শোয়া তিন হাজার ফুট পার করেছি। সত্যি কথা বলতে আমার কাছে মনে হচ্ছিলো ইতালিতে একরকম পাহাড় আর সুইজারল্যান্ডে অন্য রকম পাহাড়।
আজ আমাদের যাত্রাটা, শুধুই মনকে আনন্দ দেওয়ার জন্য। সময় কিন্তু লাগছে বেশি, তাতে কী। পৃথিবীর অনুপম লাবন্যকে দেখতে এসেছি। আমরা সবুজের রাজ্য ফেলে, বরফের রাজ্যে ছুটছি। এই ট্রেনটা হাজার হাজার ফুট বাইতে বাইতে একদম হিমবাহ ছুঁয়ে ফেলে। 2008 সালে এই ট্রেন যাত্রায় 2টি অংশ ঐতিহ্যের খেতাব জিতে। চার ঘন্টার যাত্রায় 196টি সেতু, 55টি টানেল আর সোয়া 7000 ফুট উচ্চতা ছুঁয়ে দেখা যায়।
এখন প্রকৃতি একদম রূপ পাল্টে ফেলেছে। পুরা বরফে আচ্ছাদিত জায়গাগুলো আমরা পার করছি। এবং এখানে একটা লেক, যেটা জমে গেছে। ট্রেনে থাকা প্রায় প্রতিজনই আনন্দে উদ্বেলিত। আমরা এখন বারনিনা পাস পার হচ্ছি। মাঝের এই জমে যাওয়া জলাধারটি Lake Bianco নামে পরিচিত। বছরের অনেকটা সময় যেমন বরফে মোড়া থাকে, একদম জুলাই আগস্টের গরমে, সবুজ দেখার সুযোগ থাকে।
কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে একদম রোদেলা নীল আকাশ থেকে তুষার মাখা এই প্রকৃতি দেখে অবাকই হয়েছি। এখন পার হচ্ছি Yellow Zone. এটা খুব উঁচু জায়গা প্রায় সাড়ে 2200 মিটার। এবং এটার একটা পাশে এড্রিয়াটিক সি আরেক দিকে হচ্ছে ব্লাক সি। দুটা সমুদ্রের মাঝে পর্বত পার হয়ে গেছে। এখানে শীতের রেশটা কিন্তু কাটেনি।
প্রত্যেক মানুষই এখানে আনন্দ করছে। আর পাহাড় থেকে ঝিড়ি পথ নেমে গেছে। ঝর্ণা এখন পর্যন্ত চোখে পড়েনি। আসলে জার্নিটা ছিল এরকম যে আস্তে আস্তে করে ট্রেনটা উপরে চলে যাবে। প্রায় সাড়ে 6000 থেকে 7000 ফুট এর কাছাকাছি। তারপরে আবার এটা নিচের দিকে নামা ধরবে। ইতিমধ্যে প্রকৃতির একাধিক পরিবর্তন দেখলাম। বৃষ্টি দেখলাম, তুষার দেখলাম, তার আগে সবুজ দেখলাম।
বৃষ্টিভেজা সুইজারল্যান্ডে মেঘ পাহাড়ের গান শুনছি, সাথে ট্রেনও গাইছে পু-ঝিক ঝিক। একের পর এক সেতু আর টানেল পার করছি। আর ট্রেনের বাইরে কয়েকবার মাথা বের করে বাদল দিনের জলের ফোটা মেখে ভূস্বর্গকে ভালোবাসা জানাচ্ছি। ইতিমধ্যেই ঘোষণা এলো, ট্রেন সাড়ে 5 কিলোমিটার লম্বা একটি ঐতিহাসিক টানেল পার করবে। সেই টানেল পেরিয়েই 144 কিলোমিটার এই যাত্রাপথের শেষের দিকটাই ছুটছি। এতক্ষণ যে রকম দেখছিলাম যে ট্রেনটা উপরের দিকে উঠেছিলো। এখন আবার রীতিমতো নিচের দিকে নামছে। এবং এই নামাটা তারা বলছে যে টানা 12 কিলোমিটার ট্রেনটা হাজার ফুট নিচের দিকে নামতে থাকবে।
এই ট্রেনটা সামগ্রিক বিষয়বস্তু মিলিয়ে 2008 সালে UNESCO বিশ্ব ঔতিয্যের খেতাব দেওয়া হয়েছে। আর এখন যে জায়গাটা পার করছি, হালকা হালকা বৃষ্টিমাখা কমল পরিবেশও বটে। তবে পাহাড় থেকে রীতিমতো ঝর্ণাধারা বয়ে যাচ্ছে। একটু একটু করে ঝর্ণা পড়ছে।
একটু জানিয়ে রাখছি যে কি করে প্রায় 16000 টাকার টিকেট অর্ধেক টাকায় কেনার সুযোগ পেলাম। মূলত আমরা 120 সুইস ফ্রেনক দিয়ে একটা হাফ ফেয়ার কার্ড কিনেছি। যেটা আমাদেরকে সুইজারল্যান্ডের ভিতরে প্রত্যেক জিনিসই অর্ধেক খরচে পার করতে সাহায্য করবে। এবং এই কার্ডের বদলেইতে ইতিমধ্যে আমরা 110 সুইস ফ্রাংক এর এই যে ট্রেন টিকেটটা যেটা বাংলাদেশি টাকায় মোটামুটি একটা অ্যামাউন্ট হবে। সেটাকে আমরা 55 সুইস ফ্রাংকে কিনেছি। তার পাশাপাশি এখানে যে একটা সিট রেসারভেশন। সেই সিট রেসারভেশ বাবদ আরো 24 চার্য হয়।
পৌঁছে গেছি আমাদের গন্তব্যে। এবং এখন ট্রেন থেকে নামবো। এখানে আসার পরে একদম ইন্টারনেট বিহীন অন্ধ হয়ে বসে ছিলাম। আমি দেশ থেকে আমার সিম কার্ডকে রোমি করে এনেছি সেটা কাজ করছিলোনা। ইতালি থেকে রোমিং সিম কার্ড কিনেছি সেটাও কাজ করছেনা। পরে রীতিমতো খুব বিপদে পরে খুব কষ্টে এখানকার একটি ওয়াইফাই জোগার করলাম। পরবর্তীতে সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে টিকেট অফিস থেকে একটা পর্যায়ে টিকেট কেটেছি। এবং আমার কাছে আরো তিন থেকে চার রকমের ট্রানপর্টেষনে এর পরিবর্তন আছে।
আবারও ট্রেন পরিবর্তন করে আমরা যাচ্ছি সুইজারল্যান্ডের উদ্দেশ্যে। এই ট্রেনটা আমাদেরকে এই কার স্টেশনটা থেকে নিয়ে যাচ্ছে যোবির এ। জানিয়ে রাখছি এটা যে, ঘটনাটা হচ্ছে যে আমরা ইন্টারলোকিং এ যাচ্ছি। এবং ইন্টারলোকিং যেতে আমাদের ওই স্টেশন থেকে নামার পরে আরো কিছু পরিবহন পার করে তারপরে কিন্তু গিয়ে নামতে হবে ওখানে। তো এই যাত্রা আমাদের পরছে 55 সুইস ফ্রেনক। যেটা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় সাড়ে 6000 টাকা করে পরছে। এখান থেকে তির পরখ ট্রেন বাস পাল্টে যেতে হবে হোটেল পর্যন্ত।
তার মানে দেখেন আমরা যে ইতালি থেকে সুইজারল্যান্ড আসলাম এখানে প্রায় 9300 টাকা এবং আগের ট্রেনটাতে হচ্ছে প্রায় 3000 টাকার আশেপাশে। এবং এদিকটাতে হচ্ছে আপনার আরো সবকিছু যোগ করলে আরো 17/18 হাজার টাকা হচ্ছে আমাদের আজকে পুরাপুরি লাগছে। পুরো ইতালির মিরান থেকে একদম আমাদের হোটেল পর্যন্ত এসে পৌঁছাতে।
এখন সুইজারল্যান্ডের বিখ্যাত যুরিক শহর থেকে পার হচ্ছি এবং চলছে বার্ন এর পথে। এটা আমাদের 9.28 মিনিটে শহরে নামিয়ে দিবে। পরের ট্রেন আর তিন থেকে চার মিনিটের ভেতর। তাই রীতিমতো দৌড়ে দৌড়ে নামতে হচ্ছে।
সকল চরাই-উতরাই পেরিয়ে সারাদিনে একটা লম্বা যাত্রা পথ পার করে, পৌঁছে গেছি আমাদের কাঙ্খিত সুন্দরী দেশে। সুইজারল্যান্ড থেকে আপনাদের সবাইকে জানাচ্ছি স্বাগত। আমাদের হোটেল এ এসে চেকিং করে উঠে গেছি। তখন রাত বাজে 12 টার কিছু বেশি। আমরা হালকা পাতলা কিছু খাওয়া দাওয়া সারলাম। এবং এখন ঘুমাতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। আশা করছি আপনাদের কাছে আজকের সারাদিনের যাত্রা পথের গল্প গুলো শুনতে ভালই লেগেছে। এবং এই পোষ্টের মাধ্যমে আপনি হয়তো কিছুটাও হলে ইতালি থেকে সুইজারল্যান্ড ট্রেন ভ্রমণ সর্ম্পকে জানতে পেরেছেন। আর অবশ্যই অন্য কোন পোষ্টে কথা হবে সুইজারল্যান্ড দেশের এর সব দর্শনীয় স্থান বা খাবার নিয়ে।